A Friend of Bangladesh

চলে গেলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, শশবিন্দু দা

গত কয়েকদিন যাবত মনটা খুবই বিষন্ন। সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি সক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অনেকে অনেকভাবে করছে, কোথায় কোথায় কিছুটা সফলতার মুখ দেখলেও অধিকাংশ এলাকায় বিষয়টি জটিল হচ্ছে জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রাখতে গিয়ে। সামান্য কিছু অগ্রগতি দেখলে জনগণ সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হচ্ছে তাতে সংক্রমণ বেড়ে গিয়ে প্রতিদিন এখন সংক্রমণ আর মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। গত একবছরে অনেক কাছের মানুষের, বহু প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া দেখতে হয়েছে অনেক দূর থেকে। অনেক ক্ষেত্রেই কাছে যাবার সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে যাচ্ছে। রকম পরিস্থিতিতে দু:সংবাদটি শুনলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক শফি স্যারের কাছ থেকে।

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, শশবিন্দু দা, চলে গেলেন না ফেরার দেশে এপ্রিলের ২০ তারিখ রাত ১১.৫০ ঘটিকার দিকে। তাঁর মৃত্যুর কারণ করোনা নয়। তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন, কিছুদিন যাবত থাকতেন তাঁর ছেলের কাছে ভারতের মহারাষ্ট্রে, পুনে শহরে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৯৪। তিনি পেশায় একজন মেকানিক্যাল প্রকৌশলী। কাজ করেছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায়। কিছুকাল জার্মানীতেও কাজ করেছেন। শেষ বয়সে কলকাতার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়েছেন, আরও নানাবিধ সামাজিক কাজে জড়িত ছিলেন।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাঁর কলকাতার বাসাটি উন্মুক্ত ছিলো বাংলাদেশীদের জন্য। তিনি নিজের বিছানা শেয়ার করেছেন অপরিচিত বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার সাথে। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতার অবস্থা, ওখানে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশীদের অবস্থা সর্ম্পকে তাঁর কাছ থেকে অনেক তথ্য জেনেছি। আমি যতদূর জানি, তাঁর পৈত্রিক নিবাস, জন্ম বেড়ে ওঠা সবই কলকাতায়। এক সময় তাঁর পরিবারের বাস ছিলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে। বাংলাদেশের প্রতি তাঁর মনের টান ছিলো ষোল আনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে তিনি নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ভ্রমন করতেন। কয়েক বছর আগে একবার কলকাতা থেকে বাসে করে এসে ভোরে ঢাকার উত্তরায় নামার পর ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে পাসর্পোটসহ সর্বষ্য হারিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দুর্বৃত্তরা তাঁর মাথায় আঘাত করেছিল, শেষ পর্যন্ত মাথার ক্ষত সারানোর জন্য সেলাই দিতে হয়েছিল। এত বড় একটি ঘটনার পর একটিবারের জন্যও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কমতি দেখেনি। বিপুল উৎসাহে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ভ্রমন করেছেন। গত কয়েক বছর আমি তাঁকে অবলোকন করেছি নিবিড়ভাবে, আমি দেখেছি উনি বাংলাদেশে আসছেন বছরে গড়ে কমপক্ষে তিনবার। কোন স্বার্থ ছাড়া শুধু দেশের টানে। বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, বাংলাদেশে আসলে আমার শরীরটা ভালো থাকে, মন ভালো থাকে। বেশীর ভাগ সময় থাকতেন তাঁর পরিচিত একজনের বাসায় উত্তরায় অথবা শফি স্যারের বাসায় কল্যানপুরে। বাংলা ভাষা বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রতি ছিলো তাঁর দারূন এক টান। সৈয়দ মুজতবা আলীরদেশে-বিদেশে‘, ছড়াকার সুকুমার রায়েরআবোল-তাবোল‘ এবং হুমায়ুন আহমেদের দু‘টি উপন্যাস র্জামান ভাষায়, হুমায়ুন আহমেদের আরো একটি উপন্যাস তাঁর আত্নজীবনী তিনি ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন। কলকাতার বই মেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে তিনি নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধির ন্যায় উপস্থিত থাকতেন। সবাই ভাবতো তিনি বাংলাদেশের একজন লেখক। শফি স্যার আমাকে বলেছেন, তাঁর মারাঠি ছেলের বউ-এর সাথে কথা বলার জন্য তিনি পরিণত বয়সে মারাঠি শিখেছেন। তাঁর ছেলের বউকে হয়তো তিনি বাংলা শিখিয়েছেন। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রায় সকল রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলনে তিনি হাজির থাকতেন, গান শুনতেন, উপভোগ করতেন সচেতন শ্রোতা হিসেবে। কয়েক বছর আগে নিলফামারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলন থেকে ফিরে এসে আমাকে বললেন, খুব ভালো হয়েছে, তুমি বঞ্চিত হয়েছো, গেলেও পারতে। তবে দু‘একজনের উচ্চারনে, তাল লয়ে আরো একটু যত্ন নিলে ভালো হতো। আমি বলেছিলাম, উত্তরবঙ্গে অনেক শীত, আপনার খুব কষ্ট হয়েছে। আপনি ভালো ছিলেন তো? তিনি আমাকে কৃত্রিম রাগতস্বরে বলেছিলেন, গানের কথা বলো। যতদিন চন্দ্র-সূর্য উঠবে, শশবিন্দু ভালো থাকবে। সত্যিই তাঁর প্রানশক্তি ঈর্ষা করার মতো। কৌতুক প্রিয় মানুষটির জীবন বর্তমানকে উপভোগ করার মানসিক দৃঢ়তা ছিলো দেখার মতো।

শফি স্যারের মাধ্যমে দাদার সাথে আমার পরিচয়। ধীরে ধীরে বাংলদেশ দরদী মানুষটার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সে থেকে তিনিও আমার খোঁজ খবর নিয়মিত রাখতেন। দেশের শীর্ষ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিকেএসএফ- আসলে আমার খোঁজ করতেন। পিকেএসএফ কর্তৃক আয়োজিত সব উন্নয়ন মেলায় তাঁর সরব উপস্থিতি। মাঝে মাঝে আমার বাসায় আসতেন। একদিন আমরা একসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এবং রমনা পার্ক এলাকার পুরাতন বিল্ডিং গাছ-গাছালি ঘুরে ঘুরে দেখেছি। তাঁর সান্নিধ্যে একটি সুন্দর স্মৃতিময় সকাল একসঙ্গে কাটিয়েছি। অনেক গল্প হয়েছে। কথায় কথায় আমার প্রিয় নজরুল সংগীত শিল্পী অকালপ্রয়াত ডা: অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় সর্ম্পকে অনেক অজানা তথ্য তাঁর কাছ থেকে জেনেছি।

গত বছর সময় তিনি ঢাকাতে ছিলেন। করোনার লগডাউনের কারনে কলকাতায় ফিরতে পারছিলেন না। আমাকে প্রায় প্রতিদিন ফোন করতেন। আমার পরিবারের খোঁজ-খবর নিতেন। তাঁর কিছুদিন আগে আমাদের মা, না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। আমাকে মানসিকভাবে দৃঢ় করার জন্য তাঁর জীবনের অনেক বাস্তব গল্প শুনাতেন।

বাংলাদেশ থেকে গিয়ে তিনি কিছুদিন কলকাতায় ছিলেন। তারপর ছেলের কাছে পুনেতে চলে যান। ওখান থেকে আমাকে প্রায়শ ফোন করতেন, মেসেজ পাঠাতেন। আমিও ফোন করতাম, এসএমএস আদান-প্রদান করতাম। আমাকে না পেলে শফি স্যারের কাছ থেকে আমার খোঁজ নিতেন। তিনি আমার আত্নীয় নন, কোন লেনদেনের সর্ম্পক না থাকা সত্ত্বেও নিবিড় এক ভালোবাসার সর্ম্পক তৈরী হয়েছিলো। ৯৪ বছরের এক যুবার সাথে ৫০ বছরের এক বৃদ্ধের সর্ম্পক। কী অপরিসীম মায়া, দরদ ভালোবাসায় আচ্ছন্ন করে রাখার এক যাদুকরী সম্মোহনী শক্তি ছিলো তাঁর।

বাংলাদেশের জন্য এমন একজন দরদী মানুষ এবং মানবতাবাদীর বিদায় মেনে নেয়া কষ্টের, বেদনার। সবসময় মনে আশা ছিলো, দাদা আপনার ১০০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে পারবো। বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সাথে তাঁর পরিচয় ছিলো, উঠাবসা ছিলো। কিন্তু চলাফেরা করতেন অতি সাধারণভাবে, একটি সাদা সার্টে আমি তাঁকে দেখেছি বহুদিন। বাহুল্য তাঁর চরিত্রে ছিলই না, একবারে অনুপস্থিত। এত সাদামাটা থাকেন কেন? জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে প্রশ্নের মাধ্যমে উত্তরে বলতেন, তুমি আমাকে দেখবে, শার্টকে তো আর দেখবে না।

দাদা যেখানে থাকবেন, ভালো থাকবেন, হাসি মুখে থাকবেন কামনা নিরন্তর।

তাঁর স্নেহ ভালোবাসার আবেশের স্মৃতি থাকবে চিরন্তন।

যতদিন চন্দ্র-সূর্য উঠবে, ততদিন মানুষ আপনাকে ভালোবেসে যাবে, শ্রদ্ধা করবে। বাংলাদেশ দরদী মানবতাবাদী শশবিন্দু দা, আপনার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ভালোবাসা। ওপারে আপনি ভালো থাকবেন। জানি, দেখা আমাদের হবে দু’দিন আগে- পরে।

 

একেএম নুরুজ্জামান, বাংলাদেশ।

৩০ এপ্রিল, ২০২১


 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

পরিবেশ

Welcome to My Blog_AKM Nuruzzaman

আব্বা-আম্মা